১৬ ঘন্টা আগে
১৮ ঘন্টা আগে
ছবি: সংগৃহীত
তখন যাত্রা পথে কর্ণফুলী নদীতে বহু মানুষের লাশ ভাসতে দেখেছি। গ্রামে গিয়ে রাজাকার গুন্ডাবাহিনীদের ভয়ে কখনো গোয়াল ঘরে গরু, ছাগলের সাথে, কখনো জঙ্গলে থেকেছি। কখনো বা পাশের গ্রামের কুঁড়েঘরে লুকিয়ে থেকেছি। অনেক জায়গায় ঘর থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সে এক লোমহর্ষক, বর্বর ও ভয়ঙ্কর অবস্থা। সব সময় আমাদের আতঙ্কে থাকতে হতো। কখন কাকে ধরে নিয়ে গেল, কাকে পাশবিক নির্যাতন করল, কাকে গুলি করে হত্যা করল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী কল্যাণী ঘোষ। বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বীনাজুরী গ্রামে হলেও ১৯৪৬ সালের ৫ মে তার জন্ম বন্দরনগরীর রহমতগঞ্জের প্রবাল চৌধুরী সড়কের দেওয়ানজী পুকুর লেনে। শৈশব থেকেই পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন তিনি। মাত্র ৫ বছর বয়স থেকে মা লীলাবতী চৌধুরীর কাছে সঙ্গীত, অভিনয় ও নৃত্যে শিক্ষা লাভ করেন। পরে উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নৃত্যের উপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাবা প্রকৌশলী মনোমোহন চৌধুরীও ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ।
১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বেতারের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন এই শব্দসৈনিক। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯৬৬ সালে স্নাতক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ব্যাচে বাংলা সাহিত্যে (১৯৬৭-১৯৬৮) এমএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন আত্মপ্রত্যয়ী কণ্ঠযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ। সেই সাথে ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি সায়েন্সে একবছর পড়াশোনা করেন।
১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সেন্ট প্লাসিডস হাইস্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার পেশাগত জীবন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের বিশেষ গ্রেডের একজন সংগীতশিল্পী। সুদীর্ঘ ৬১ বছর ধরে বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন এই কণ্ঠযোদ্ধা।
স্বাধীনতার পর তিনি বাংলা একাডেমির অফিসার পদে যোগদান করেন। বাংলা একাডেমির ডিকশনারি রচনার কাজে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, গণসঙ্গীত, বাংলাদেশের লেখক পরিচিতি, ছোটদের অভিধান ও চরিতাভিধান ইত্যাদি। বাংলা একাডেমিতে পাঠ্যপুস্তক, গ্রন্থাগার, বিপণন, সংস্কৃতি, গবেষণা, সংকলন ও ফোকলোর বিভাগে বিভিন্ন সময়ে ৩২ বছর ধরে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে উপপরিচালক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
তাঁর পরিবারের ছয় ভাই-বোন, বড় ভাইয়ের স্ত্রী, বড়বোনের স্বামী প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার এস সি দাশসহ মোট ৮জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। ৮মার্চ বিশ্ব নারীদিবস উপলক্ষে সে সময়ের ঘটনাবলি নিয়ে অকুতোভয় এই শব্দসৈনিক ও কণ্ঠযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষের সঙ্গে কথা হয় টেকওয়ার্ল্ডবিডি ডটকমের। তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপের চুম্বক অংশ টেকওয়ার্ল্ডবিডির পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের শুরুটা কীভাবে?
কল্যাণী ঘোষ: আজ থেকে ৫১ বছর আগের কথা। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ২৫ বছর। আমি তখন চট্টগ্রামের পাথরঘাটা সেন্ট প্লাসিডস মিশনারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। তখন পাকিস্তানি বর্বর নরপশু হায়নাদের পাশবিক নির্যাতন ও অত্যাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ডাক দেন। আমিও ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে পথে বেরিয়ে পড়ি।
‘‘তখন যাত্রা পথে কর্ণফুলী নদীতে বহু মানুষের লাশ ভাসতে দেখেছি। গ্রামে গিয়ে রাজাকার গুন্ডাবাহিনীদের ভয়ে কখনো গোয়াল ঘরে গরু, ছাগলের সাথে, কখনো জঙ্গলে থেকেছি। কখনো বা পাশের গ্রামের কুঁড়েঘরে লুকিয়ে থেকেছি। অনেক জায়গায় ঘর থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সে এক লোমহর্ষক, বর্বর ও ভয়ঙ্কর অবস্থা। সব সময় আমাদের আতঙ্কে থাকতে হতো। কখন কাকে ধরে নিয়ে গেল, কাকে পাশবিক নির্যাতন করল, কাকে গুলি করে হত্যা করল।’’
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গান রেকর্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কল্যাণী ঘোষ: ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকের পর চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান রেকর্ডিংয়ের জন্য আমাকে এবং প্রয়াত ভাই প্রবাল চৌধুরী ও বোন উমা খানকে ডাকা হয়। তখন আমরা তিন ভাই-বোন এবং আরও কিছু বিশিষ্ট শিল্পী মিলে ওই গানগুলি রেকর্ডিং করি। আমার প্রয়াত সংগীত গুরু ও শিল্পী মোহন লাল দাশ, প্রয়াত সৈয়দ আনোয়ার মুফতির কথা, সুর ও প্রযোজনায় আমরা প্রায় আট থেকে দশটা গান রেকর্ডিং করি। পরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্টেশন থেকে ২৬ থেকে ৩০ মার্চ ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলি প্রচার করা হয়।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় সে দিনগুলির কথা জানতে চাই।
কল্যাণী ঘোষ: মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৬মার্চ চট্টগ্রাম আক্রান্ত হয়। তখন চট্টগ্রাম শহরে ছিল শুধু আগুনের লেলিহান শিখা। ২৮ মার্চ পর্যন্ত শহরে থাকার পর আমি, মা-বাবা, আমার ভাই প্রবাল চৌধুরী, বোন উমা খানসহ সবাই চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি রাউজানের বীনাজুরীতে। তখন যাত্রা পথে কর্ণফুলী নদীতে বহু মানুষের লাশ ভাসতে দেখেছি। গ্রামে গিয়ে রাজাকার গুন্ডাবাহিনীদের ভয়ে কখনো গোয়াল ঘরে গরু, ছাগলের সাথে, কখনো জঙ্গলে থেকেছি। কখনো বা পাশের গ্রামের কুঁড়েঘরে লুকিয়ে থেকেছি। অনেক জায়গায় ঘর থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সে এক লোমহর্ষক, বর্বর ও ভয়ঙ্কর অবস্থা। সব সময় আমাদের আতঙ্কে থাকতে হতো। কখন কাকে ধরে নিয়ে গেল, কাকে পাশবিক নির্যাতন করল, কাকে গুলি করে হত্যা করল। এর মধ্যে ১৩এপ্রিল পাশের গ্রামে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নূতন সিংহসহ আরও কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করেছিল রাজাকার বাহিনী। রাজাকারদের অত্যাচারে গ্রামে ১৫ দিনের বেশি থাকতে পারিনি।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: পরে কি হলো?
কল্যাণী ঘোষ: ২১ এপ্রিল। চারদিকে মুষলধারে বৃষ্টি ও প্রচণ্ড বজ্রপাত হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার তাগিদে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে এই বৃষ্টির মধ্যেই কাদামাটির পিচ্ছিল পথে অসুস্থ বাবা ইঞ্জিনিয়ার মনমোহন চৌধুরী, মা লীলাবতী চৌধুরী, স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সুরঞ্জন ঘোষ, আমার দেড় বছরের কন্যা ইন্দ্রানী ঘোষ শম্পা, ভাই প্রবাল চৌধুরী, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, বোন উমা খান, দেবী চৌধুরী, পূর্ণিমা দাশ চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী খোকাসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মোট ২৩জন সদস্য গভীর রাতে এক কাপড়ে, স্বদেশ প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে, অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা শুরু করি। আমরা যারা নারী ছিলাম তারা সবাই মুখে কাদামাটি ও কালি মেখে, বোরকা পরে অজানার পথে যাত্রা শুরু করি।
সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের রামগড়ের সাবরুমে এসে যখন পৌঁছুলাম, তখন সীমান্তের ওপারে জল বসন্ত। এপারে কলেরা মহামারি আকার ধারণ করেছিল। হাজার হাজার মানুষের স্রোতে এপার-ওপার একাকার হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। আমার বাবা ছিল ডায়াবেটিস রোগী। পাহাড়ের উঁচু-নীচু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বাবার পায়ের নিচে কাঁচ-পাথরের ঘষাঘষিতে ফোসকা পড়ে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। বাবা আর হাঁটতে পারছিলেন না। বাবা বারবার বলছিলেন আমাকে রেখে তোরা পালিয়ে যা। না হলে তোরা কেউ বাঁচতে পারবি না। কিন্তু আমরা বাবার কথায় কান না দিয়ে প্রিয়তম বাবাকে ছেড়ে এক পা-ও যাইনি। আমার স্বামী ও ভাই প্রবাল চৌধুরী ও আরও দুই জ্যাঠতুতো ভাই বাবাকে একটি চাদরের মাঝখানে বসিয়ে বাকি পথ বহন করে নিয়ে যায়।
‘‘আমরা তিন ভাই-বোন মিলে সমবেত কণ্ঠে ৫০টারও বেশি গণজাগরণমূলক গান রেকর্ড করেছি। আমাদের গাওয়া মুক্তিযুদ্ধের গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘নও জোয়ান সব এগিয়ে চলো’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’, ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা (প্রবাল চৌধুরী)’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব’, ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি’, ‘সপ্ত সাগর ওঠে’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ প্রভৃতি।’’
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: তারপর. . .
কল্যাণী ঘোষ: এরই মধ্যে রামগড় বর্ডারে পৌঁছুলে আমার ছোট বোন উমা খান জল বসন্তে আক্রান্ত হয়ে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই দুঃসময়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্য আমার বন্ধু প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান, ফটিকছড়ির প্রাক্তন এমপি ও বন্ধু নুরুল আলম, ডাক্তার জাফরুল্লাহ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমার মেঝো বোন দেবী চৌধুরীর দশ মাসের একমাত্র ছোট শিশুও তখন রক্ত আমাশয় হয়ে মরণাপন্ন অবস্থা। তখন সবাই বলছিল বাচ্চাটাকে ফেলে চলে যাও। আমরা তাকেও ফেলে যেতে পারিনি।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: কলকাতায় পৌঁছানোর পর ঐ দিনগুলি কেমন ছিল?
কল্যাণী ঘোষ: ১৯৭১ সালের ৫ মে। বিপদসংকুল পথঘাট পেরিয়ে সপরিবারে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছি। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঠিকানা খুঁজতে থাকি। কত মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করেও কোনো খবর পাইনি। এরই মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ হয় আমাদের তিন ভাই-বোনের। সেখানেই দেখা হয় ড. সানজিদা খাতুনের সাথে। ওই দিন আমাদের গান শুনে তিনি তাঁর সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’তে যোগ দিতে বলেন, যেটা পরবর্তীতে ‘মুক্তির গান’ নামে পরিচিত হয়েছে। পরদিনই আমরা যোগ দিয়েছিলাম। তাঁদের সাথে ট্রাকে ট্রাকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে গান গেয়েছি। এই গ্রুপটা তৈরি করেছিলেন ড. সানজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, মোস্তফা মনোয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম, কলকাতার বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখেরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও আমি ২৫/৩০ জন শিল্পীদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পীগোষ্ঠী’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনগণকে উজ্জীবিত, উৎসাহিত, উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করেছি।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনাদের কণ্ঠে গাওয়া কালজয়ী গানগুলি সম্পর্কে কিছু বলুন।
কল্যাণী ঘোষ: তখন বালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, প্রণোদিৎ বড়ুয়া প্রমুখের সুর ও প্রযোজনায় সমবেত কণ্ঠে আমরা অসংখ্য কালজয়ী গান গেয়েছি। তাছাড়া আমরা তিন ভাই-বোন মিলে সমবেত কণ্ঠে ৫০টারও বেশি গণজাগরণমূলক গান রেকর্ড করেছি। আমাদের গাওয়া মুক্তিযুদ্ধের গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘নও জোয়ান সব এগিয়ে চলো’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’, ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা (প্রবাল চৌধুরী)’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব’, ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি’, ‘সপ্ত সাগর ওঠে’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ প্রভৃতি।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: মুক্তিযুদ্ধের সময় গানগুলি মানুষকে কতটা অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিল বলে আপনি মনে করেন?
কল্যাণী ঘোষ: দেখুন, মানুষ যখন কোনো যুদ্ধের মধ্যে থাকে, তখন তাদের ভেতরে মানসিক ও আত্মিক শক্তির প্রয়োজন হয়। আত্মার খোরাকের যে জায়গাটা, সে জায়গাটাতে দেশাত্মবোধক, গণজাগরণমূলক গানগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা শিল্পীরা আমাদের একমাত্র অস্ত্র কণ্ঠ এবং বন্দুকের বুলেটতুল্য দেশপ্রেমের শব্দ দিয়ে সুরের ঝংকারে মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝড় তুলেছি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের কণ্ঠে গাওয়া কালজয়ী দেশাত্মবোধক ও গণজাগরণমূলক গানগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক শক্তির জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানী রাজাকার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে মুক্তিকামী বাঙালির মন যখন ভেঙে পড়েছিল, তখন গানগুলি তাদের নতুনভাবে বাঁচতে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি, আপামর বাঙালির ভেতরের সেই বৈপ্লবিক তাড়নাকে জাগ্রত ও উজ্জীবিত করতে গানগুলি খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা খেয়ে, না খেয়ে যখন যুদ্ধ করছিলেন, তখন আমরা সবসময় জাগরণমূলক গান গেয়ে তাদের মনে উৎসাহ জুগিয়েছি। যখন তারা পাকিস্তানি হায়েনাদের আঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন একমাত্র গানগুলিই ছিল তাদের মানসিক খাদ্য। যেটি তাদের মনে শক্তি ও নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছে।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: এই কালজয়ী গানগুলি এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। কীভাবে এগুলিকে সংরক্ষণ করা যায়?
কল্যাণী ঘোষ: মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মতো কণ্ঠযোদ্ধাদের গাওয়া কালজয়ী দেশাত্মবোধক ও গণজাগরণমূলক গানগুলি দেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদস্বরূপ। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, প্রণোদিৎ বড়ুয়া প্রমুখের সুর ও প্রযোজনায় সমবেত কণ্ঠে যেসব গান প্রচারিত হতো, সব গানই সময়ের প্রয়োজনে লেখা ও সুর দেয়া হয়। একদিকে গান লেখা হচ্ছে, অন্যদিকে সাথে সাথে সুর করে রেকর্ডিং করে প্রচার করা হয়। এসব কালজয়ী বিখ্যাত গানগুলির বেশিরভাগ সুরকার ও গীতিকাররা আজ আমাদের মাঝে নেই। এসকল সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠযোদ্ধাদের কালজয়ী গানগুলি সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি। সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে ওই গানগুলি একটা ওয়েবসাইট তৈরি করে সেখানে রাখার ব্যবস্থা করে, তাহলে প্রয়াত সুরকারদের আত্মা শান্তি পাবে বলে আমার বিশ্বাস। এখন গানগুলি অনেক অবহেলায় রয়েছে। বর্তমানে কিছুসংখ্যক তরুণ শিল্পী গানের আসল সুর ও কথাকে বিকৃত করে ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করছে। এভাবে সুরস্রষ্টাদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে অপমান করা হচ্ছে। দেশের অমূল্য সম্পদ দেশাত্মবোধক ও গণজাগরণমূলক গানগুলি যদি সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল প্লাটফর্মে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে দেশপ্রেমী তরুণরা দেশের সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ পাবে।
টেকওয়ার্ল্ডবিডি: আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আমাদের টেকওয়ার্ল্ডবিডির সকল পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম ও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ ধন্যবাদ। আপনার দীর্ঘায়ু, সুস্থ ও সুন্দর জীবন কামনা করছি। অফুরন্ত শুভ কামনা।
কল্যাণী ঘোষ: ৮মার্চ বিশ্ব নারীদিবস উপলক্ষে আমাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করার জন্য নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনাদেরও জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
উজ্জ্বল এ গমেজ
অধ্যাপক ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষক ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ। উদ্ভাবন...