১৭ ঘন্টা আগে
১ দিন আগে
ছবি: সংগৃহীত
স্টারলিংক বাংলাদেশে এলে দুর্গম এলাকায় খুব সহজে উচ্চগতির ইন্টারনেট-সেবা পাওয়া যাবে। ফলে ইন্টারনেট-সেবার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য চলে যাবে। গ্রামে বসেই উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিংসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক কাজ করতে পারবেন সব শ্রেণির মানুষেরা। এতে করে কমে যেতে পারে দেশে বিরাজমান ডিজিটাল ডিভাইড।
আগামী তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ইলন মাস্কের কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক চালু করার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা আসলে দেশীয় ইন্টারনেট সেবাদাতা উদ্যোক্তা কোম্পানির উপর কি ধরনের প্রভাব পড়বে, সেটি নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আইএসপিএবি ব্যবসায়ী ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন স্টারলিংক আসলে এর প্রভাব হতে পারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক।
বাংলাদেশে গ্রাহকদের জন্য এখন যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হয়, তা সাবমেরিন ক্যাবলনির্ভর। অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে তারের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ এনে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা (আইএসপি) মানুষকে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হয় স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে।
স্টারলিংকের মূল প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের ওয়েবসাইট মতে, তাদের ইন্টারনেট-সেবা জিওস্টেশনারি (ভূস্থির উপগ্রহ) থেকে আসে, যা ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপর থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্থাপিত হাজার হাজার স্যাটেলাইটের একটি সমষ্টি হচ্ছে স্টারলিংক, যা পুরো বিশ্বকেই উচ্চগতির ইন্টারনেট-সেবা দিতে পারে।
প্রযুক্তি খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক বাংলাদেশে এলে দুর্গম এলাকায় খুব সহজে উচ্চগতির ইন্টারনেট-সেবা পাওয়া যাবে। ফলে ইন্টারনেট-সেবার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য চলে যাবে। গ্রামে বসেই উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিংসহ অন্যান্য ইন্টারনেটভিত্তিক কাজ করতে পারবেন সব শ্রেণির মানুষেরা। এতে করে কমে যেতে পারে দেশে বিরাজমান ডিজিটাল ডিভাইড।
বিটিআরসির গাইডলাইন অনুযায়ী, নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট (এনজিএসও) সেবাদাতাদের বিটিআরসির অনুমোদন নিয়ে শুধুমাত্র ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), মেশিন টু মেশিন যোগাযোগ, আর্থ স্টেশন ইন মোশন এবং প্রতিটি সাইটের জন্য ব্যাকহল সেবা দিতে পারবে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী থাকবে? জানতে চাইলে আইএসপিএবি'র সভাপতি ইমদাদুল হক টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা সারা দেশেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিয়ে আসছি। শুধু দুর্গম ও পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের সেবাটা নেই। তাছাড়া সব জায়গায় আমাদের দৃশ্যমান কার্যক্রম রয়েছে। ফাইবারের সাহায্যে গুণগতমানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা দিয়ে আসছি। আমরা ৫শ টাকায় যে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছি, স্টারলিংকের গ্রাহক কিন্তু তারা না। তাদের গ্রহকরা হবেন কোর্পোরেট। দেশের এই বিশেষ শ্রেণির গ্রাহকদের টার্গেট করে স্টারলিংক ব্যবসা করার পরিকল্পনা করছে। কোর্পোরেট শ্রেণির গ্রাহকরা তো আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্যেই আছে। এ ক্ষেত্রে এই টার্গেট গ্রুপের ইন্টারনেট সেবা দানে আসবে প্রতিযোগীতা। তবে, বাংলাদেশের মতো দেশে স্টারলিংকের মতো বিশ্বমানের নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাই। তবে দেশীয় ইন্টারনেট উদ্যোক্তাদের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা ব্যবসা করে দেশের টাকা দেশেই রাখি। বিটিআরসির গাইডলাইনে যদি এমন হয় যে, দেশীয় উদ্যোক্তরা সুরক্ষা পেল না, তাহলে তো দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে। আর এর জন্য দেশের লাভ কতটুকু হবে সেটা সময়ই বলবে। তবে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেখানে আমাদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা এখনও পৌঁছেনি, সেখানে এই ইন্টারনেট সেব নেওয়া যেতে পারে। তবে গণহারে সব জায়গায় অনুমোদন দেওয়াটা দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসায় চ্যালেঞ্জের হতে পারে।’
ইউনাইটেড আইসিটি ফোরামের আহ্বায়ক ও প্রধান সংগঠক ফয়সল আলিম টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্টারলিংক বাংলাদেশে একটা নতুন ভবিষ্যত দেখাবে। তবে, আমি মনে করি, এটা গ্রাহক হিসেবে ব্যক্তিগত ব্যবসায় খুব বেশি শাক্তিশালী হবে না। উচ্চ মূল্যের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ভোক্তাদের মধ্যে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না।কেননা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা ৫শ টাকা হলেই ভাল ইন্টারনেট পেয়ে যাই। অন্যদিকে এত ব্যয়বহুল ইন্টারনেট সেবা সবার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সেদিক থেকে ভোক্তা হিসেবে স্টারলিংকের সুবিধাটা শক্তিশালী হবে না। অন্যদিকে বিটুবি হিসেবে এটা দেশের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি হিসেবে ভোক্তাদের জন্য দামের বিষয়ে আমি সন্দিহান। ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সা ও কর্পোরেট সেবায় এটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেত পারে।’
স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা নিয়ে ভয়েস ফর রিফর্ম প্লাটফর্মের সহ-আহ্বায়ক ও বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা যারা রাজধানীতে বসবাস করছি তাদের জন্য স্টারলিংকের ইন্টারনেট অতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। কেননা, আমরা যারা শহরে থাকি তারা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করি। সব জায়গায় ইন্টারনেট আছে। তাই এই ইন্টারনেট সেবা আমাদের জন্য অতিরিক্ত কোন সুবিধা দিবে না। এটা মূলত, সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা আছেন, যেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছেনি, মোবাইল ডাটার উপর নির্ভর করে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। আবার ফোরজি মোবাইল নেটওয়ার্কও ভাল মতো পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন, তাদের জন্য এই উচ্চগতির ইন্টারনেটটা অনেক উপকারে আসবে। কেননা, স্টারলিংক যেহেতু স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট-সেবা এর মাধ্যমে দুর্গম অঞ্চল ইন্টারনেটের আওতায় আনা যাবে। দেশে যে ইন্টারনেট-সেবার মান নিয়ে সমস্যা রয়েছে। স্যাটেলাইট সেবা এলে যারা মানসম্পন্ন ইন্টারনেট চান, তাদের জন্য বিকল্প সুযোগ তৈরি হবে। এই দিক বিবেচনা করে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।’
বেসিসের অ্যাসোসিয়েট কমিটির চেয়ারম্যান রাফেল কবির টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা গুণগতমানসম্পন্ন সেবা দিবে। এটা একটা বিশ্ব মানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তাই, আমাদের দেশের সফটওয়্যার ও আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রির যারা বিদেশের কোম্পানির সাথে সফটওয়্যার আমদানি-রফিতানি ও আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন তাদের এই উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের জন্য এই ইন্টারনেট সেবা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। তবে, এটা যেহেতু বিদেশি কোম্পানি, তাই দেশের একটা বড় অংশের মুদ্রা বিদেশে চলে যাবে। আবার অন্যদিকে, এ উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার সাহায্যে সফটওয়্যার আমদানি-রফিতানি ও আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে বিদেশ থেকেও বৈদাশিক মুদ্রা আয় করা যাবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদানকারী স্টারলিংক কি দেশীয় স্যাটেলাইট খাত, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইমাদুর রহমান টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে দেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবার যাত্রাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। বিশ্বমানের এই ইন্টারনেট সেবা দেশে আসলে এখানে ইন্টারনেট সংযুক্তির জন্য নতুন একটা সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের প্যারালাল একটা সুযোগ যোগ হবে। বর্তমানে দেশে কোথাও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ আছে, কোথাও মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে, কোন কোন জায়গায় কিছুই নেই, যেখানে কোন সংযোগ নেই, সেখানে এই স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা নিতে পারে। গ্রাহক পর্যায়ে দামটা কত হবে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা চালু হলে দেশীয় ইন্টানেট সেবাদাতাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রযুতিযোগিতা তৈরি হবে।’
দেশে ইন্টারনেট নিয়ে আয়োজিত একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘স্টারলিংক বাংলাদেশের শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চল, উত্তরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন ও উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করবে, যা লোডশেডিং বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাধা থেকে মুক্ত থাকবে। এটি নিরবচ্ছিন্ন এবং উচ্চমানের সেবা নিশ্চিত করবে। যেহেতু বাংলাদেশে টেলিকম-গ্রেড ফাইবার নেটওয়ার্কের কভারেজ সীমিত এবং অনেক দূরবর্তী এলাকায় এখনো লোডশেডিং সমস্যা রয়েছে, স্টারলিংক আমাদের উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার, এনজিও এবং এসএমই ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিন কার্যক্রম এবং ডিজিটাল অর্থনৈতিক উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করবে।’
চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চালুর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা, টেসলা ও এক্স-এর মালিক ইলন মাস্ক। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্পেসএক্সের সিইও ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং দেশে স্টারলিংক স্যাটেলাইট সেবা চালুর আহ্বান জানান। সেই সুবাধে সরকার চেষ্টা করছে আগামী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে বাংলাদেশে স্টারলিংক চালুর জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা যায়।
উজ্জ্বল এ গমেজ
অধ্যাপক ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষক ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ। উদ্ভাবন...