২০ বছরে আইটিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নিতে হবে যেসব উদ্যোগ

প্রকাশ: ৮ মার্চ, ২০২৩, ০৩:০১
Card image cap

আমাদের দেশে মেয়েরা সাধারণত ক্যারিয়ারের প্রস্তুতি নিয়ে বড় হয় না। খুব কমসংখ্যক মেয়েই আছে যারা কলেজ পর্যায় থেকে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে থাকে। এদের সংখ্যাটা ৩-৪% হবে।সেখান থেকে টেকনোলজি ওয়ার্ল্ডে আসার যে প্রস্তুতির প্রয়োজন সেটা নেই। আরেকটা দিক হলো, টেকনোলজি বিষয়টা যেহেতু প্র্যাকটিজনির্ভর, সেহেতু মেয়েটা যখন কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে, তখন অনেক সময় নিয়ে প্র্যাকটিজ করতে পারে। বিয়ের পর তার জীবনের বাস্তবতাটা বদলে যায়।

উজ্জ্বল এ গমেজ

আমাদের দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি মাল্টিন্যাশনাল আইটি কোম্পানিগুলোতে নারীদের কাজ করার সময় নানানভাবে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। যেমন, বড় কোন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেয়ার সময় ধারণা করা হয় যে, নারী কর্মীকে প্রজেক্টের টিম লিডারের দায়িত্ব দিলে নির্দিষ্ট সময় মতো কাজটা সম্পন্ন করতে পারবে না। নারী কর্মীরা পুরুষের সাথে সমতালে কাজ করতে পারবেন না। নারীর সক্ষমতা থাকার পরও তাঁদের প্রতি আস্থার সংকট ধারণার বশবর্তী হয়ে এই ধরনের চিন্তা করা হয়ে থাকে। আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মত দিয়েছেন বেসিসের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং ইউ ওয়াই সিস্টেমস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা এ রহমান।

তাঁর মতে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে আইটি ইন্ডাস্ট্রির বড় একটা অবদান রয়েছে। আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে কাজ করছেন। কিন্তু নারীদের কাজের জন্য পরিবেশটা এখনও সেভাবে তৈরি হয়ে উঠেনি। নারীদের কাজ করতে গিয়ে এখনও নানান ভাবে বাধার সন্মুখীন হতে হয়।

২০০৩ সাল থেকে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন তিনি। দীর্ঘ ২০বছরে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের অংশগ্রহণের ধারাটা কেমন ছিল জানতে চাইলে টেকওয়ার্ল্ডবিডি ডটকমকে বেসিসের এই সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারহানা এ রহমান বলেন, আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে ২০ বছর ধরে কাজ করছি। এই লম্বা জার্নিতে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলবো আইটিতে নারীদের অংশগ্রহণের ধারাটা ছিল খুবই ধীরগতি। নারীদের অংশগ্রহণ যেমনটা হওয়ার কথা ছিল সে তুলনায় কম। ২০০৫ সাল পর্যন্ত কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। যারা এসেছে তারা নিজের ইচ্ছাতেই এসেছে। যারা আইটি গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরির জন্য কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে তখন সেভাবে তাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। 

যেমন, একজন নারীকে কোন প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টিম লিডারদের ধারণা থাকে যে, উনাকে এই দায়িত্ব দিলে ঠিক সময় মতো প্রজেক্টের কাজটা শেষ করতে পারবেন কি-না। কেননা একজন পুরুষ যেমন অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করতে পারেন, সেখানে নারীকে পরিবারে সন্তানদের জন্য সময় মতো ঘরে ফিরতে হয়। চাইলেও প্রজেক্টে পুরুষের মতো সময় দিতে পারেন না। অন্যদিকে নারীর প্রজেক্টে কাজ করার মতো নিজেকে যোগ্য করে তৈরি করতে না পারলে যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাবে তাকে বড় কোন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেয়া হয় না। এখানে আইটি প্রফেশনাল হিসেবে নারীর কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া ও টিকে থাকাটা দুটি বিষয়ে উপরে নির্ভর করছে। প্রথমত, নারীকে কাজ করার জন্য নিজেকে উপযুক্তভাবে তৈরি করা, দ্বিতীয়ত, ইন্ডাস্ট্রিকেও নারীর কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।

আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ছোটবেলা থেকে নারীদের ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনার অভাব বলে মনে করছেন এই সফল আইটি উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, আমাদের দেশে মেয়েরা সাধারণত ক্যারিয়ারের প্রস্তুতি নিয়ে বড় হয় না। খুব কমসংখ্যক মেয়েই আছে যারা কলেজ পর্যায় থেকে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে থাকে। এদের সংখ্যাটা ৩-৪% হবে।সেখান থেকে টেকনোলজি ওয়ার্ল্ডে আসার যে প্রস্তুতির প্রয়োজন সেটা নেই। আরেকটা দিক হলো, টেকনোলজি বিষয়টা যেহেতু প্র্যাকটিজনির্ভর, সেহেতু মেয়েটা যখন কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে, তখন অনেক সময় নিয়ে প্র্যাকটিজ করতে পারে। বিয়ের পর তার জীবনের বাস্তবতাটা বদলে যায়। পরিবার সামলে ক্যারিয়ারে সময় দেয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা অফিসে অনেক সময় রাত পর্যন্ত প্রজেক্টের কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত সময় দিতে হয়। এটা অনেক সময় পরিবার থেকে মেনে নিতে পারে না। তখন পারিবারিক কারণে ওই নারীকে  চাকরিটা ছাড়তে হয়। 

‘‘নারীকে এই দায়িত্ব দিলে ঠিক সময় মতো প্রজেক্টের কাজটা শেষ করতে পারবেন কি-না। কেননা একজন পুরুষ যেমন অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করতে পারেন, সেখানে নারীকে পরিবারে সন্তানদের জন্য সময় মতো ঘরে ফিরতে হয়। চাইলেও প্রজেক্টে পুরুষের মতো সময় দিতে পারেন না। অন্যদিকে নারীর প্রজেক্টে কাজ করার মতো নিজেকে যোগ্য করে তৈরি করতে না পারলে যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাবে তাকে বড় কোন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেয়া হয় না।’’

বেসিসের সাবেক এই জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বলেন, আইটি প্রফেশনাল হিসেবে কোম্পানির চাকরি ছাড়লেও বেশির ভাগ আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বপ্নবাজ নারীরা নিজের মেধা ও প্রতিভা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে হাঁটেন। নিজের মেধা থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে স্বপ্নের উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করেন। স্বপ্নের উদ্যোগের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অর্থিক সমস্যাসহ নানান প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। তখন নিজের পরিবার, স্বামীর সাপোর্ট না পেয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। ২০০৫ সালে দেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ১৫ জনের মতো ছিল। পরে ২০০৮ সালে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন ও কার্যক্রম শুরু করলে ধীরে ধীরে নারীরা আইটিতে পড়াশোনার বিষয়ে সিরিয়াস হতে থাকে। সময়ের পালা-বদলে আইটিতে নারী গ্র্যাজুয়েট ও প্রফেশনালের সংখ্যাটা দিন দিন বাড়তে থাকে। 

নারীদের আইটি ও ক্যারিয়ারভিত্তিক সংগঠনগুলি নারীদের মধ্যে একটা বিপ্লব এনেছে বলে মনে করেন ইউ ওয়াই সিস্টেমস লিমিটেডের প্রধান এই নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে নারীদের আইটি ও ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন, ফোরাম গড়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে এসে সংগঠনগুলির কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়। এসব সংগঠনের মাধ্যমে আইটিতে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও উদ্যোক্তা বিষয়ক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে নারীদের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়। আইটিতে গ্রাজুয়েট হওয়া নারীরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অন্যের অধীনে কাজ না করে, নিজে কোম্পানি দিয়ে, বস হয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করে, নিজের কোম্পানিতে আরও বেকার নারীকে দিয়ে কাজ করানোর সুযোগ করে দেয়া ধারণা নারীর মাথায় আসে। তখন দেশে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। গত বছরের একটা স্ট্যাটেস্টিক মতে এখন দেশে ৪০-৫০ জনের মতো সফল নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। অন্যদিকে নানান প্রতিকূলতা সামলে আইটি প্রফেশনাল হিসেবে এখন  নারীরা বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, ব্যাংক, আইটি প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করছেন। 

স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নারীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন? জবাবে ফারহানা এ রহমান জানান, বর্তমান সরকার আইসিটিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবতা ছিল একটা বিষয়। স্মার্ট বাংলাদেশ হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিবর্তিত ভার্সন। এখানে সবকিছুই স্মার্ট ডিভাইসের সাহায্যে করা হবে। সব প্লাটফর্ম হবে স্মার্ট। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নারী-পুরুষের উভয়ের সমান ভূমিকা রয়েছে।  সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যেসব প্লাটফর্ম তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়াটা এখন সময়ে দাবি। আইটি ইন্ডাস্ট্রির নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব হবে এই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার এই  মাহাকর্মযজ্ঞে যেনো নারীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়। সরকারিভাবেও যেনো পলিসি ম্যাকিংয়ের জায়গাতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে সে বিষয়টাতে গুরুত্ব দেয়া সময়ের দাবি। সরকার ও আইটি ইন্ডাস্ট্রি যখন এসব বিষয়গুলিতে সঠিকভাবে নারীদের মূল্যায়ন করবে, তখন স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নারীরা সব সেক্টরে অবদান রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ৭৯ বার

সম্পর্কিত পোস্ট