সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে বাড়বে প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ

প্রকাশ: ১৪ মার্চ, ২০২৩, ০৯:১৫
Card image cap

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা তাঁদের মেয়েদের প্রযুক্তির মতো সম্ভাবনাময় ও সময়োপযোগী বিষয়ে পড়াশোনা করাতে আগ্রহী না। তথ্যপ্রযুক্তিকে ধরে নেয়া হয় কঠিন বিষয় হিসেবে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ছেলেদের বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়।  তাই তারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতের পরিবর্তে অন্য কোন বিষয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে থাকেন।

উজ্জ্বল এ গমেজ

বিশ্বায়নের এই যুগে  অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে  নারীদের প্রযুক্তিতে ক্ষমতায়ন করা সময়ের দাবি। তাই বর্তমান সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও উদ্যোগ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করাসহ আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই প্রযুক্তিতে বাড়বে নারীর অংশগ্রহণ বলে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল। 

তাঁর মতে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা তাঁদের মেয়েদের প্রযুক্তির মতো সম্ভাবনাময় ও সময়োপযোগী বিষয়ে পড়াশোনা করাতে আগ্রহী না। তথ্যপ্রযুক্তিকে ধরে নেয়া হয় কঠিন বিষয় হিসেবে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ছেলেদের বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়।  তাই তারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতের পরিবর্তে অন্য কোন বিষয়ে মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে থাকেন। অনেক মেধাবী মেয়েরা তাদের পরিবারের এমন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিতে পড়াশোনা করতে পারে না। অথচ বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার এডা লাভলেস ছিলেন একজন নারী। প্রথম কম্পাইলার নিয়ে কাজ করা গ্রেস হপার তৈরি করেন প্রোগ্রামিং ভাষা কোবল (সিওবিওএল)।

২০ বছরে আমাদের দেশে প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনায় নারীদের অংশগ্রহণ কতটা বেড়েছে? জানতে চাইলে টেকওয়ার্ল্ডবিডি ডটকমকে ড. লাফিফা জামাল বলেন, ১৯৯৫ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই, তখন আমাদের ব্যাচে আমরা মাত্র তিনজন নারী শিক্ষার্থী ছিলাম। এখন তুলনামূলকভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ  বেড়েছে এবং তাঁরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সাফল্যের সঙ্গে কাজও করছেন। আগে আমরা দেখতাম, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কম্পিউটার বা প্রযুক্তি বিষয়ে ২০-২৫ শতাংশ নারী পড়াশোনা করতেন। এখন সেটি ৩০-৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।   

সরকারি হিসাবমতে কর্মক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রায় ১৫ শতাংশ নারী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কাজ করেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অবস্থান শতকরা ১ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) একটি জরিপে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে পড়াশোনা করছেন, এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে প্রোগ্রামিংকে পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহী। অথচ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিত বিষয়ে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ প্রতিবছর বাড়ছে ১৭ শতাংশ হারে, যেখানে অন্যান্য খাতে এ বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বেই প্রকৌশল ও প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। আমাদের পাবলিক পরীক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফলে নারী শিক্ষার্থীদের আধিপত্য দেখতে পাই। তাহলে কেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে নারীরা পিছিয়ে থাকবেন? মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারার কারণেই সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।

‘‘প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষকে সমানভাবে কাজটা ভাগ করে নিতে হবে। পরিবারের দায়িত্ব পালনের দিকে থেকে সবসময় বলা হয় সুপার মম, কেন বলা হয় না সুপার ড্যাড? সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্বটা মা-বাবা দুজনকেই সমানভাবে নিতে হবে। যতদিন না নারীরা পুরুষের সাথে সমান সমান ভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে, ততদিন পর্যন্ত নারীরা ক্যারিয়ারের দিক থেকে এগিয়ে যেতে পারবেন না। নারীরাই ঘর সামলাবে, এই সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে হবে।’’

তহালে কী বলা যায় যে পরিবারের বাবা-মায়ের সঠিক গাইড-লাইনের অভাবে প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কম? জবাবে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ কম থাকার অন্যতম কারণ হলো, ছোটবেলা থেকে নারীদের ক্যারিয়ার নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। আমাদের দেশে নারীরা সাধারণত কোন বিষয়ের প্রতি তাঁদের আগ্রহ আছে, কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবে, বড় হয়ে কোন পেশার সাথে যুক্ত হবে, এসব লক্ষ্য তাঁদের স্থির থাকে না। খুব কমসংখ্যক নারীই আছেন যারা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় থেকে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে থাকেন। অন্যদিকে, বাবা-মারাও নারীদের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে ও সিদ্ধান্ত নিতে ছেলে সন্তানকেই বেশি গাইড করেন। ফলে প্রযুক্তি ক্যারিয়ারে আসার যে প্রস্তুতির প্রয়োজন সেটা নারীর না থাকাতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে আর তাঁর পক্ষে প্রযুক্তিতে আসা হয়ে উঠে না।

আরেকটা দিক হলো, নারীদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ারের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেও অনেক সময় দিতে হয়। পরিবার সামলে ক্যারিয়ারে সময় দেয়াটা অনেক সময়ই তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষ সদস্যরাও যদি পারিবারিক কাজে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে নারীদের পথচলা অনেক সহজ হয়। যেমন, অনেক সময়  নারীকে অফিসে রাত পর্যন্ত প্রজেক্টের ডেডলাইনে সম্পন্ন করার জন্য কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত সময় দিতে হয়। এটা অনেক সময় পরিবার থেকে মেনে নিতে পারে না। তবে বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে অফিসের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে কিছু কাজ বাসা থেকেও করা সম্ভব হচ্ছে।

তিনি বলেন, আশার কথা হলো, সময়ের পালা-বদলের সাথে সাথে সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাবা-মারা সচেতন হচ্ছেন। প্রযুক্তির বদৌলতে নারীরা তাঁদের জীবনের লক্ষ্য, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শিখছেন। এখন রাজধানীসহ সারা দেশের নারীরা ক্যারিয়ার সচেতন হচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তিতে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনা করে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। তবে এ সংখ্যাটা আরও বাড়াতে হবে।

কীভাবে প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব? ড. লাফিফা জামাল বলেন, সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হলেও প্রেক্ষাপট এখনও ততটা বদলায়নি। তবে পরিবর্তন আসছে। নারীরা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছেন। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজে কাজ করছেন, ব্যবসা করছেন। প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষকে সমানভাবে কাজটা ভাগ করে নিতে হবে। পরিবারের দায়িত্ব পালনের দিকে থেকে সবসময় বলা হয় সুপার মম, কেন বলা হয় না সুপার ড্যাড? সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্বটা মা-বাবা দুজনকেই সমানভাবে নিতে হবে। যতদিন না নারীরা পুরুষের সাথে সমান সমান ভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে, ততদিন পর্যন্ত নারীরা ক্যারিয়ারের দিক থেকে এগিয়ে যেতে পারবেন না। নারীরাই ঘর সামলাবে, এই সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে হবে।   সমাজের এই ট্যাবু ভাঙার জন্য নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। 

প্রযুক্তি শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন? নারীদের প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে স্কুল-কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে আসা এই অধ্যাপক বলেন,  প্রযুক্তি শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে স্কুলজীবন থেকে নারীদের প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিতের মতো বিষয়গুলি নারীদের জন্য কঠিন উল্লেখ না করে, ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাঁদের প্রযুক্তি শিক্ষায় উৎসাহ দিতে হবে। গ্রাম পর্যায়েও অনেক নারী এখন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। তাই সঠিক প্রশিক্ষণ ও পদক্ষেপ নিলে এ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আনতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নে নারীদের এখন নিজেকেই নির্ভরযোগ্য পরামর্শকের অবস্থানে ভাবতে হবে। অন্যদিকে, প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের দিক দিয়ে নারী এখনো অনেক পিছিয়ে। প্রত্যেক নারীর মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তা নিয়ে যেন সে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে এ পেশায় জেন্ডার-বৈষম্য কমিয়ে আনতে উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ, প্রণোদনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে প্রযুক্তি খাতে জেন্ডার-বৈষম্য কমিয়ে আনতে করণীয় ঠিক করতে হবে।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ৩৬ বার