আইটিপণ্য নিয়ে মূল ধারার ব্যবসা করা নারীর সংখ্যা কম

প্রকাশ: ১৬ মার্চ, ২০২৩, ০১:৪৩
Card image cap

বেসিসের পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমানে ১০০-এর বেশি নারী সদস্য রয়েছেন যারা আইটিপণ্যকে নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা করছেন। বাক্কোতে ২৫ জনের মতো এবং ই-ক্যাবেও আইটিপণ্যকে নিয়ে ব্যবসা করার মূল ধারার বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা আছেন। সব মিলে আইটিপণ্যকে নিয়ে ব্যবসা করা নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যাটা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার তুলনায় এ সংখ্যাটা খুবই কম। আগের তুলনায় আইটিতে নারীর অংশগ্রহণ অনেকটা বেড়েছে। তবে সংখ্যাটা যথেষ্ট না। আরও অনেক বাড়াতে হবে।

উজ্জ্বল এ গমেজ

ইন্ডাস্ট্রিতে যারা আইটিপণ্য নিয়ে মূল ধারার ব্যবসা করছেন এমন নারী উদ্যোক্তাদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় খুঁজে বের করতে হবে। যেসব নারীদের আর্থিক সাহায্য দিলে তাঁদের  ব্যবসার ডেভেলপমেন্টে সাহায্য হবে, উদ্ভাবনী কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হবে, এমন আইটি নারী উদ্যোক্তাদের তালিকা করে তাঁদের আর্থিক প্রণোদনা দিলে  ঘুরে দাঁড়াতে পারে ব্যবসার মোড় বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ উইম্যান ইন টেকনোলজির (বিডাব্লিউআইটি) সভাপতি রেজওয়ানা খান।

তাঁর মতে, একজন নারী উদ্যোক্তাকে তাঁর স্বপ্নের উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় সেটি হলো, পারিবারিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ। পারিবারিক বিষয়টা নিজে ম্যানেজ করে নিলেও আর্থিক চ্যালেঞ্জটা থাকে বেশি। তাই এক্ষেত্রে সরকারিভাবে এমন নারীদের পাশে দাঁড়ালে তাঁদের পক্ষে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা  সহজ হয়ে উঠে।

গত ১৮ বছরে ইন্ডাস্ট্রিতে আইটিপণ্যকে নিয়ে ব্যবসা করা মূল ধারার নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা কতটা বেড়েছে? জানতে চাইলে স্টার কম্পিউটার সিস্টেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ানা খান  টেকওয়ার্ল্ডবিডি ডটকমকে বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে আইটিপণ্যকে নিয়ে ব্যবসা করা মূল ধারার নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। বেসিসের পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমানে ১০০-এর বেশি নারী সদস্য রয়েছেন যারা আইটিপণ্যকে নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা করছেন। বাক্কোতে ২৫ জনের মতো এবং ই-ক্যাবেও আইটিপণ্যকে নিয়ে ব্যবসা করার মূল ধারার বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা আছেন। সব মিলে আইটিপণ্যকে নিয়ে ব্যবসা করা নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যাটা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে ইন্ডাস্ট্রির চাহিদার তুলনায় এ সংখ্যাটা খুবই কম। আগের তুলনায় আইটিতে নারীর অংশগ্রহণ অনেকটা বেড়েছে। তবে সংখ্যাটা যথেষ্ট না। আরও অনেক বাড়াতে হবে।

আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আত্মপ্রত্যয়ী এই উদ্যোক্তা বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে দেড় যুগ ধরে কাজ করছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, ২০১০ সাল পর্যন্ত যেসব নারীরা আইটিপণ্য নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন, তাঁদের জন্য এ জার্নিটা সহজ ছিল না। তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকটা পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে তারপর যুদ্ধে জয়ী হয়ে তাঁদের উদ্যোক্তা হতে হয়েছে। যেসকল আত্মপ্রত্যয়ী নারী এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, শুধু তাঁরাই আইটিতে উদ্যোক্তা হয়েছেন। অন্যদিকে, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের স্বপ্নের উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু করার পর একটা ভাল অবস্থানে না আসার আগেই আবার অনেকে নানান সমস্যার কারণে ঝরে পড়েছেন। তবে আশার কথা হলো, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন নারীরা আইটিতে পড়ালেখা করছেন। প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারপর ক্যারিয়ার হিসেবে কেউ অনলাইনে বিজনেস করছেন, কেউ বা উদ্যোক্তা হচ্ছেন। কেউ আবার উদ্ভাবনী কাজ নিয়ে বিজনেস করছেন। 

‘‘যারা এআই, আইওটি, ব্লকচেইন, মোবাইল গেমিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছেন, কল সেন্টার চালাচ্ছে এমন নারী উদ্যোক্তাদের খুঁজে প্রণোদনা দিলে তাঁরা প্রতিষ্ঠানকে আরও ডেভেলপ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠান বড় হলে নারী আইটি প্রফেশনালদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। এভাবে আইটিতে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়বে। আর যাদের প্রকৃত অর্থে আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন তাঁদের না দিলে সরকারের এমন মহতি উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।’’

ইন্ডাস্ট্রিতে মূল ধারার নারী উদ্যোক্তাদের ঝরে পড়ার কারণ জানালেন আইটি সেক্টরে আলো ছড়ানো  সফল এই আইটিপণ্য ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে ক্যারিয়ার জীবন শুরু করার পর যখন পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসে, তখন নারীকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করতে হয়। ক্যারিয়ার, চাকরি, উদ্যোক্তা জীবনের নানান চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় নারীদের। একজন নারী উদ্যোক্তার নিজের ব্যবসাকে শূন্য থেকে দাঁড় করাতে যে পরিমাণে কঠোর পরিশ্রম, সময়, মেধা, অর্থ ব্যয় করতে হয়, তা করতে গিয়ে দেখা যায় পরিবারের জন্য তার সময় কমে যায়। এভাবে যখন সংসার থেকে নিজের ব্যবসাকে বেশি সময় দিতে থাকেন, তখন অনেক পরিবারই বিষয়টা মেনে নিতে পারেন না। আর নারী উদ্যোক্তাদের পারিবারিক সাপোর্ট না পেলে, সে উদ্যোগ তার পক্ষে সফলতার মুখ দেখানো সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই অনেক নারীকে সংসার ও উদ্যোক্তা জীবনের ব্যালেন্স করতে না পেরে নিজের স্বপ্নের উদ্যোগ বাস্তবায়ন থকে সরে আসতে হয়। এছাড়াও উদ্যোক্তাদের আর্থিক ও কর্মক্ষেত্রে পরিবেশগত নানান জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ থাকে। এসবের কারণে অনেক  স্বপ্নবাজ নারীই উদ্যোক্তা জীবন থেকে ঝরে পড়েন। তখন কেউ কেউ বিভিন্ন বেসকারি কোম্পানিতে চাকরিও করে থাকেন। কেউ বা সংসারেই সময় দেন।

সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মকে টুলস হিসেবে ব্যবহারকারী নারী অনলাইন ব্যবসায়ীরা কী নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে দাবি করতে পারেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ উইম্যান ইন টেকনোলজির (বিডাব্লিউআইটি) সভাপতি বলেন, যেসকল নারীরা অনলাইনে ব্যবসা করছেন প্রথমত, তাঁরা তাঁদের পরিবরারকে অর্থনৈতিকভাবে সাপোর্ট করছেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। এটা খুবই ভাল দিক। আর অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মকে টুলস হিসেবে ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদেরকে উদ্যোক্তা বলা যায় কিনা এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলবো যে, ফলের মৌসুমে আম, লিচু, তরমুজ, কাঁঠাল বা বড় পাইকারি মার্কেট থেকে রেডিমেট শাড়ি-লুঙ্গির মতো কাপড়লতা, চীন, কোরিয়া থেকে কসমেট্রিকস কিনে অনলাইনে বিক্রি করে কিছু টাকা ইনকাম করলেই তাদেরকে উদ্যোক্তা বলা যায় না। তাদেরকে অনলাইন ব্যবসায়ী বলা যাবে। উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য হলো সব উদ্যোক্তাই নিজের উদ্ভাবন বা তৈরি পণ্য নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু সব ব্যবসায়ীরা উদ্যোক্তা হতে পারে না।

‘‘২০১০ সাল পর্যন্ত যেসব নারীরা আইটিপণ্য নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন, তাঁদের জন্য এ জার্নিটা সহজ ছিল না। তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকটা পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে তারপর যুদ্ধে জয়ী হয়ে তাঁদের উদ্যোক্তা হতে হয়েছে। যেসকল আত্মপ্রত্যয়ী নারী এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, শুধু তাঁরাই আইটিতে উদ্যোক্তা হয়েছেন।’’

একজনকে ছোট উদ্যোক্তা হতে গেলেও তার কিছু জিনিস অবশ্যই থাকতে হবে। যেমন, একটা ফিজিক্যাল অফিস বা প্রতিষ্ঠান, ওয়্যার হাউজ, কর্মচারী, ট্রেড লাইসেন্স, ডিবিআইডি, টিআইএন ও ভিআইএন লাইসেন্স, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে একাউন্ট খোলা  এসব কিছু অবশ্যই থাকতে হবে। যেকোন বৈধ ব্যবসার জন্য অনুমোদিত কাগজ হলো ট্রেড লাইসেন্স। এই লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। একজন উদ্যোক্তা নিয়মিত সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে থাকেন। যেসব উদ্যোক্তারা নিজেরা কোন পণ্য তৈরি করে বা উৎপাদন করে অনলাইনে একটা প্রফেশনাল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করে প্রপার ডকুমেন্টটেশন সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে, সরকারকে নির্ধারিত ভ্যাট, ট্যাক্স দিবে তাদেরকে উদ্যোক্তা বলা যাবে।

আইটিতে নারীর ক্ষমতায়নে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে কম, এর কারণ কী? জবাবে বিডাব্লিউআইটি সভাপতি বলেন, বর্তমানে শতকরা ৫১ ভাগ নারী। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে এবং নারী উদ্যোক্তাদের সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন ধরনের যুগোপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। হারপাওয়ার প্রজেক্ট এগুলির মধ্যে অন্যতম। এই প্রকল্পের আওতায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের চার বিভাগে প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৫ হাজার স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা তৈরি করার কথা রয়েছে।এসব প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয়তা বুঝে তাঁদের পুঁজি সংকট কাটানোর জন্য সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে অর্থিক প্রণোদনা চালু করেছে।  এটা সরকারের খুবই যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। সরকার আইসিটিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।   

এছাড়াও গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-কমার্স খাতে ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেটি হলো, ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (ডিবিআইডি) সিস্টেম। এখন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নিতে ডিবিআইডি নিতে হবে। এটি নিবন্ধন নেওয়ার কার্যক্রম সিস্টেম। এ সিস্টেম চালুর পেছনে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের। এমন সুন্দর উদ্যোগের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ ই-ক্যাবকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগগুলি বাস্তবায়ন হচ্ছে সেগুলি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ বাস্তবায়নকে আরেকটু ত্বরান্বিত করতে কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেমন, আইটি ইন্ডাস্ট্রির কোন কোন সেক্টরে, কাদেরকে আর্থিকভাবে প্রণোদনা দেয়া যায় সেগুলির একটা তালিকা করতে হবে। এজন্য আইটিপণ্য নিয়ে মূল ধারার ব্যবসা করা নারীদের খুঁজে বের করতে হবে। যেমন, যারা এআই, আইওটি, ব্লকচেইন, মোবাইল গেমিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছেন, কল সেন্টার চালাচ্ছে এমন নারী উদ্যোক্তাদের খুঁজে প্রণোদনা দিলে তারা প্রতিষ্ঠানকে আরও ডেভেলপ করতে পারবে। প্রতিষ্ঠান বড় হলে নারী আইটি প্রফেশনালদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। এভাবে আইটিতে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়বে। আর যাদের প্রকৃত অর্থে আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন তাঁদের না দিলে সরকারের এমন মহতি উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।

অন্যদিকে, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যাও এক্ষেত্রে বড় বাধা। পরিবার থেকে মেয়েদের আইটিকে নিয়ে পড়াশোনায় নিরুৎসাহিত করা হয়। এর জন্য রুট লেভেল থেকেই মেয়েরা আইটি লাইনে আসতে পারে না। যেখানে আইটিতেই পড়াশোনা করতে পারে না, সেখানে সরকারের নেয়া উদ্যোগেও অংশগ্রহণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ৪৯ বার