রবিবার

ঢাকা, ২৩ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ


মুখোমুখি

‘পারিবারিক মূল্যবোধ ও বাবা-মায়ের জীবনাদর্শ সন্তানদের সুন্দর পরিবার গঠনের পূর্বশর্ত’

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, দুপুর ১০:২৬

উজ্জ্বল এ গমেজ

Card image

ছবি: টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ

যুগে যুগে এই বিয়ের বন্ধনবিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্র। তাছাড়া একজন মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়েউঠা এবং মূল্যবোধ, নৈতিকতার মত  মানবিকগুণাবলীতে গুণান্বিত হবার পেছনে রয়েছে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। 

বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। এর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থা বজায় রাখা এবং এর উন্নয়নে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কেবল দুটি মানুষের মধ্যকার একটি সম্পর্ক নয়, বরং দুটি পরিবারের সাথে সম্পর্কিত। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথেও জড়িত। কেননা একটি সুস্থ পরিবার মানে একটি সুস্থ সমাজ। আর একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজই একটি সমৃদ্ধ এবং উন্নত রাষ্ট্রের ভিত্তি। তাই যুগে যুগে এই বিয়ের বন্ধন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্র। তাছাড়া একজন মানুষ সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা এবং মূল্যবোধ, নৈতিকতার মত  মানবিক গুণাবলীতে গুণান্বিত হবার পেছনে রয়েছে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

একটা সময় মানুষ পাত্রপাত্রী ঠিক করতে তিন পুরুষের খোঁজ-খবরও নিত। বংশ পরিচয় দেখে সম্পর্ক করত। বর্তমানে বিষয়গুলো হেসে উড়িয়ে দিলেও এর পেছনের কারণগুলো নেহাতই ফেলনা নয়। বর্তমানে দুজন মানুষের সুসম্পর্ক তৈরিতে তাদের মধ্যকার আত্মনিবেদিত মনোভাব, ত্যাগ, নিঃশর্ত ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি ভাববার বিষয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র উন্নয়নের মূল ভিত্তি এই বিয়ের সম্পর্কটি নিয়ে কাজ করছেন আমাদের আজকের ‘অনন্যা’ হুরায়রা শিশির।

বর্তমানে ‘বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’ উদ্যোগটির পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুরায়রা শিশির। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বিয়ে এবং সম্পর্ক-বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।অসংখ্য মানুষের বিয়ে ও পারিবারের সম্পর্ক সংক্রান্ত সমস্যার সামাধান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রফেশনাল দক্ষতা অর্জন করেন আত্মপ্রত্যয়ী এই উদ্যোক্তা।

তিনি গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গ্রামীণফোনে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু করেন কর্ম জীবন। সেখানে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে চাকরি করেন। এরই মধ্যে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সম্পন্ন করেন এমবিএ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি  এরপর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে স্টার্টআপ ফ্যাকালটিতে চাকরি করেন এক বছর। জানার আগ্রহ থেকে পরে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে প্রোফেশনাল কোর্স এসিবিএ করেন। এখানেই শেষ নয়। জ্ঞানের পিপাসা বাড়তে থাকে তার। আবার ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্জন করেন মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এমডিএস) ডিগ্রি।

প্রযুক্তির যুগে পরিবার ও সমাজে বসবাসরত মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, মানবিক ও মনঃস্তাত্বিক সম্পর্কগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন, এগুলো কোন দিকে যাচ্ছে, পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে এই পারিবারিক সম্পর্কের গুরুত্ব কতটুকু, একটা সুস্থ ও শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধন তৈরিতে প্রযুক্তির ভূমিকা কতটুকু, এমন নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করেছেন টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের অনলাইন ইনচার্জ উজ্জ্বল এ গমেজ।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: দুনিয়ায় এতো কিছু রেখে আপনি বিয়ে ও পারিবারিক সম্পর্কের মতো একটা মনঃস্তাত্বিক বিষয় নিয়ে কাজ করার উৎসাহটা পেলেন কীভাবে?
হুরায়রা শিশির: দেখুন, দীর্ঘদিন ধরে টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিতে চাকরি করে কর্পোরেট জগতের মানুষগুলোকে আমার কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কর্মস্থলটা ছিল আমার দ্বিতীয় পরিবারের মতো। তাদের সঙ্গে কাজ করে প্রতিদিন একটু একটু করে বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। সহকর্মীদের জীবন দর্শন, আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতি সবকিছু দেখেছি। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে দেখতে দেখতে এসব বিষয়গুলোর প্রতি একটা অন্যরকম আগ্রহ তৈরি হয় মনে। অন্যদিকে, আমার পড়ার বিষয় ছিল সমাজে বসবাসরত মানুষের মানবতা, মানুষের  সাথে মানুষের সামাজিক ও আত্মিক সম্পর্ক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ, সমাজের অবস্থা ইত্যাদি। প্রাতিষ্ঠানিক কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং উচ্চশিক্ষার বিষয়বস্তু নিয়ে নিজে থেকে কিছু একটা করে সমাজে আলাদা পরিচয় তৈরি করার  তাগিদ অনুভব করি।

২০১৮ সালে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা এবং সেসঙ্গে পড়াশোনার জ্ঞান ও দক্ষতাকে পুঁজি করে মানুষের কল্যাণে একটা অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি করি। নাম দেই ‘বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’। তখন থেকে সারাদেশের বিয়ের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীদের জন্য ম্যারিজ অ্যান্ড রিলেশনশিপের কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে আসছি। এছাড়াও সারাদেশের নবীন ও প্রবীণ দম্পতিদের বিয়ের আগের ও পরবর্তী সংসার জীবনের মনঃস্তাত্বিক সম্পর্কের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে কনসালটেন্সি করছি।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে  ‘বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’ প্লাটফর্ম কী ধরনের কাজ করে থাকে?
হুরায়রা শিশির: আমরা সবাই চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিই। কিন্তু বিয়ে নিয়ে কারোর কোনো প্রস্তুতি নেই। বিয়ের আগে অবশ্যই মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। আমি একটি নতুন পরিবেশে যাব। অন্য একটি মানুষ আমার পরিবারে নতুন সদস্য হয়ে আসবে। তার সঙ্গে নিজেকে কেমন করে মানিয়ে নিব, সেগুলো আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন আছে। কারণ, বিয়ের আগের মানসিকতা ও বিয়ের পরের মানসিকতার পরিবর্তন হয়। দুটি মানুষ পারিবারিক, দাম্পত্য, সামাজিক সম্পর্কে কিভাবে ভাল থাকবে আমরা এই সম্পর্ক উন্নয়নেই কাজ করে থাকি।

সমাজে বিভিন্ন পেশার, নানা মতের, নানা রকমের মানুষ আছে, যাদের পছন্দ নানা রকমের হয়ে থাকে। সবার পছন্দ এক নয়। সবার মাঝেই ভিন্নতা থাকে। আর আমরা মূলত তাদের পছন্দের মিল বন্ধনের মাধ্যমেই তাদের মনের মত মানুষটি খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও সাহায্য করে থাকি। এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে বা সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা নিয়মিত পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বাস্তবধর্মী ভিডিও তৈরি করে সেগুলো আমাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইনসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। সেগুলো দেখে যারা যোগাযোগ করেন তাদেরও প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রয়োজন অনুসারে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: এ কাজ করতে গিয়ে আপনাকে কী ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে?
হুরায়রা শিশির: একজন উদ্যোক্তা হিসেবে যেকোনো কাজ করতে গেলে সমস্যা বা বাধা আসবেই। আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের উদ্যোক্তা হিসেব কাজ করতে গেলে তো সমস্যা থাকবেই। আমি বিয়ে ও পারিবারিক সম্পর্কের মতো একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করছি। এখানে  নারী-পুরুষরা তাদের পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের সমস্যাগুলো নিয়ে যখন আসেন, তখন আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। এটা আমি শুধু একজন নারী হিসেবে শুনি না, শুনি একজন মানুষ হিসেবে। যাতে সবাই  তাদের মনের ভেতরের কষ্টের কথাগুলো স্বচ্ছন্দে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে পারেন।

আমি তাদের কথা শুনে প্রয়োজন অনুসারে  ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি। মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে যখন আমি ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করি, মানুষ সেগুলোর সাথে আমার ব্যাক্তি জীবনের সর্ম্পক খুজেঁ বেড়ায় । বিষয়টা সাধারণ মানুষ বুঝতে চায় না। এটা একটি অন্যতম সমস্যা বলতে পারি।

বস্তুত, আমাদের সমাজে  এখনো মানুষের মনোজগতে বিয়ের গুরুত্বটা কাজ করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সেভাবে গড়ে উঠেনি। আবার আর্থিক সমস্যা, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের কাজটি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নতুন হওয়ায় একদম শুরু থেকেই সব কিছু নিজের হাতে করতে হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য কেউ কোনো আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করেননি। আমি নিজের কষ্টার্জিত জমানো টাকা দিয়ে ‘বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’ প্লাটফর্মটি তৈরি করেছি।  এখন একটা স্মার্ট, ডায়নামিক ও দক্ষ টিম নিয়ে নিজের হাতে সব কাজ পরিচালনা করছি। অন্যদিকে, পরিবার থেকে বাধা আসা খুবই সাধারণ বিষয়। কারণ আমার কাজটা মানুষের মনোজগত নিয়ে। তাই কিছু ঝুঁকি তো আছেই।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: পাত্র বা পাত্রী খুঁজতে ‘বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’ প্লাটফর্ম কীভাবে সেবা দিয়ে থাকে?
হুরায়রা শিশির: বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’ প্লাটফর্মে বিভিন্ন সম্মানজনক পেশার যেমন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি কর্মকর্তা, কর্পোরেট, শিক্ষক, ব্যাংকারসহ দেশে-বিদেশে অবস্থানরত পাত্র বা পাত্রীর সন্ধান দেওয়া হয়। যারা আগ্রহী তারা প্লাটফর্মটিতে যোগাযোগ করতে পারেন। আবার যারা একান্ত নিজের মতো করে খুঁজে নিতে চান। যাদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে বা নিজের কোন সীমাবদ্ধতা বা পরিকল্পনা আছে, তাদের জন্য গুগল প্লে-স্টোরে রয়েছে মোবাইল অ্যাপের ব্যবস্থা। অ্যাপটি গুগল প্লে-স্টোরে গিয়ে ফ্রিতে রেজিস্ট্রেশন করে   ডাউনলোড করা যাবে। অ্যাপে নিজের মতো করে পছন্দের পাত্র-পাত্রী নিবার্চনের সুযোগ রয়েছে। সেখানে পাত্র-পাত্রীর প্রয়োজনীয় তথ্য দিলে সে অনুসারে আমরা যোগাযোগ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: স্মার্ট যুগে একজন পাত্র বা পাত্রী অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করার সময় যেসব তথ্য দিবে এর নিরাপত্তা কতটুকু রয়েছে?
হুরায়রা শিশির: আমরা প্রত্যেকজন পাত্র বা পাত্রীর পরিচয় সংক্রান্ত তথ্যকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টা মাথায় রাখি। কেননা তারা আমার কাছে অনেক সম্মানের। তাদের তথ্যকে সুরক্ষা ও নিরাপদ করার প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগই নিয়েছি। আশা করছি, সবার তথ্যই সব সময় সুরক্ষিত ও নিরাপদে থাকবে।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: বিয়েকে বলা হয় সামাজিক বন্ধন। পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বন্ধনের গুরুত্ব কতটুকু?
হুরায়রা শিশির: বিয়ে প্রত্যেক মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে পরিবার।একইসঙ্গে মা-বাবা, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে বসবাস করছে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ। পরিবার হলো প্রতিটি মানুষের শক্তির উৎস। আত্মবিশ্বাস তৈরির সূতিকাগার। মানুষের প্রথম শিক্ষা শুরু পরিবার হতে। নিবিড় বন্ধন রয়েছে পরিবারের মধ্যে।পারিবারিক জীবন বিবর্জিত মানব সভ্যতা কল্পনা করা যায় না। আর পরিবারের প্রয়োজনেই সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে গড়ে উঠে সমাজ ব্যবস্থা। তাই সমাজ সৃষ্টিতে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ইত্যাদি পারিবারিক সুস্থতা ও দৃঢ়তার ওপরই বহুলাংশে নির্ভরশীল। যদি পারিবারিক জীবন অসুস্থ ও নড়বড়ে হয়, তাতে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তাহলে সমাজ জীবনেও নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকে।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: উদ্যোগের প্রতিপাদ্য ‘ফ্রিডম অ্যান্ড ট্রুথ’ বা  ‘স্বাধীনতা এবং সত্য’ -এর সাথে আপনার সেবার অন্তর্নিহিত মিল কতটুকু?
হুরায়রা শিশির: উদ্যোগের  প্রতিপাদ্য ‘স্বাধীনতা এবং সত্য’ রাখার কারণ হল-বিয়ের মত একটা সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বস্ততা। আর এই সম্পর্কটা নিয়েই আমরা কাজ করি। বিয়ের মাধ্যমে দু’জন স্বাধীন ব্যক্তি বিশ্বস্ততার বন্ধনে আবদ্ধ হয়।  এই সম্পর্কে পারস্পারিক মতামতের স্বাধীনতা থাকাটা খুবই জরুরি। পরস্পরের স্বাধীন মতামতের উপর শ্রদ্ধা থাকা উচিত। সেসাথে দরকার একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ততা। তাই এ দুটি বিষয়কে আমরা আমাদের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে  নিয়েছি।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

হুরায়রা শিশির: আমি ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে যদি বলি তাহলে বলতে হবে  একটা সময় ছিল যখন প্রবাসী স্বামীর সাথে স্ত্রীর যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি অথবা ফোনে কথা বলা। দীর্ঘদিন কেউ কাউকে দেখতে পেত না। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কল্যাণে যোগাযোগ হয়ে উঠেছে আরও সহজ এবং কার্যকরী। ভিডিও কলের মাধ্যমের তারা এখন একে অপরকে দেখতে পায়। সন্তান দেখতে পায় তার বাবাকে।  পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিংবা নিরাপত্তায় সবাই এখন দূরে থেকেও কাছে। উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো এখন উচ্চ শিক্ষার্থে তাদের সন্তানকে বিদেশে পাঠাতে ভরসা পায়। এর মূল কারণ প্রযুক্তি। 

এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মানুষ প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছে। পারস্পারি চিন্তা-ভাবনা, সম্পর্ক উন্নয়ন এবং যোগাযোগের একটি দ্রুততম প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আপনি সব ধরনের মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারেন যা অন্যভাবে সম্ভব হত না।পেশাগত সমস্যার সমাধান করার জন্যও সবচেয়ে কার্যকরী তথ্য পেতে আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। তবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো প্রতিদিন আমাদের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলোতে বিভিন্ন প্রভাব ও ফেলছে যা উড়িয়ে দেবার মত নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের শৈলীগুলো বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তন করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যাধিক সময় ব্যয় করার কারণে মানুষের মধ্যে দুঃখ, অসন্তোষ, হতাশা বা একাকীত্বের অনুভূতি তীব্র হচ্ছে যা ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করছে।  কারণ বেশি ব্যবহারে বাস্তব জীবনের সাথে বাড়ছে দূরত্ব। ব্যক্তি জীবনে বিষন্নতা, উদ্বেগ, একাকীত্ব, আত্ম-ক্ষতি এবং এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় আসতে পারে। রঙ্গিন স্বপ্ন দেখে অনেকে নিজের সংসার ছেড়েও অন্যের হাত ধরে চলে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে সাজানো সুখের সংসার। এসব চিত্র আমাদের দেশসহ সারা বিশ্বের। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে একটা নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত। এটাতে আসক্ত হওয়া যাবে না। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করলে এর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ:  সমাজ ও পারিবারিক জীবনে প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে কি করা উচিত?
হুরায়রা শিশির: বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন। তবে পরিবার থেকে সন্তানদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে, সন্তানদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারিবারিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সন্তানদের এসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সচেতন করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের পারস্পারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে  হবে। সন্তানদের সাথে রুটিন করে নিয়মিত বাবা-মায়ের সময় কাটাতে হবে। তাদেরকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে হবে। সেসাথে বয়স অনুসারে তাদের পরিবারের ছোটখাটো দায়িত্ব দিতে হবে। বাড়ির বয়স্কদের প্রতি খেয়াল রাখা ইত্যাদির উপরে তাদের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি তাদেরকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রতি বেশি উৎসাহিত করতে হবে।  এক্ষেত্রে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: গ্রামীণফোনের চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের কারণ যাই হোক না কেনো, আপনার মতে কোনটি ভাল?
হুরায়রা শিশির: যখন কর্পোরেট জব করেছি, তখন দুহাতে অনেক টাকা ইনকাম করেছি। তখন টাকা ও আরাম বেশি ছিল। খরচও করেছি সেভাবে। এখন দিন-রাত এক করে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দিয়ে যে টাকা ইনকাম করি, সেখান থেকে আমার পুরো টিমটাকে বেতন দিতে হয়। অফিস ভাড়া, ম্যানেজমেন্টসহ সব খরচ চালাতে হয়। এখন ২০ টাকা খরচ করলেও চিন্তা করতে হয় এটা অনেক কষ্টের বিনিময়ে ইনকামের টাকা। তবে এটা আমি জোর দিয়ে বলব যে, কর্পোরেট জগতে না গেলে আজকে আমি এখানে আসতে পারতাম না।এত কিছু শিখতে পারতাম না, এমনকি আত্মবিশ্বাসের সাথে এত কথা বলতেও পারতাম না। এখন নিজের ব্যবসার কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি।

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিদিন আমাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। সবগুলো থেকেই প্রতিদিন একটু একটু করে নতুন কিছু শিখছি। অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। এই যে লড়াই করছি, এতে একটা অন্যরকম আত্মতৃপ্তি আছে। ভাললাগা কাজ করে মনে। আমি আমার ম্যারিজ অ্যান্ড রিলেশনশিপের কাউন্সিলিং বিষয়টা ভীষণভাবে উপভোগ করছি। তাই বলবো দুটোই ভাল। তবে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যবসায় এলে সুবিধা অনেক বেশি।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: যারা নতুন সংসার জীবন শুরুর কথা ভাবছেন তাদের প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
হুরায়রা শিশির: জীবন একটাই। এটা খুব সুন্দর। এটাকে অবহেলায় ফুরিয়ে যেতে দেবেন না।  নিজের মতো করে পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নিন। তবে খোঁজার সময় শুধু ইমোশনাল বা রেশনাল না হয়ে, বরং নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে  খুঁজে নিন। এতে তাড়াহুড়া করার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা এটা জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত। সময় নিন, আলোচনা করুন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কাউকে খুব নিজের পছন্দ মতো খুঁজে নিতে পারাও একটা কঠিন পরীক্ষা। ঠকে যাবার ভয় যেমন আছে, তেমনি জিতে যাবার আনন্দ উপভোগ করতে চাইলে ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে মনের মানুষটি সঠিক পদ্ধতিতে খুঁজে নিতে হবে। মন থেকে চাইলে আর সঠিক মাধ্যমে সততা ও সম্মানের সাথে খুঁজলে সঠিক জীবনসাথী পাওয়া কঠিন বিষয় না। দেখবেন পেয়ে গেছেন।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
হুরায়রা শিশির: একদিন ‘বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল’ অনলাইন প্লাটফর্মটি অনেক বড় হবে। এখানে কাজ করবে অসংখ্য মানুষ। প্রযুক্তির যুগে দেশসহ সারাবিশ্বের ব্যস্ত মানুষের সঠিক জীবন সঙ্গী খুঁজে দিবে এই প্লাটফর্ম। মানুষের জীবনকে করে তুলবে প্রজাপতির মত রঙ্গিন। নতুন জীবনে দুটি মানুষ একে অন্যকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে সুখের পরিবার গড়বে। সবাই সুখে ও শান্তিতে বসবাস করবে। নতুন করে বাঁচতে শিখাবে হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা। এভাবে প্রযুক্তির মাধ্যম ব্যবহার করে আস্তে আস্তে মানুষের  সেবা করে যেতে চাই।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ৭২২ বার

এ সম্পর্কিত আরও খবর